উত্তম গুণের অধিকারী ব্যক্তিকে পছন্দ করে সবাই। আকর্ষণীয় ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠে সে। সুন্দর গুণাবলির মাধ্যমে সমাজে তৈরি হয় শান্তি, মৈত্রী ও ভালোবাসা। তাই সুশৃঙ্খল সুখী সমাজ বিনির্মাণে উত্তম গুণাবলির ভূমিকা অপরিসীম।
উত্তম চরিত্রের মূর্ত প্রতীক হলেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)। মহানবী (সা.)-এর জীবনের পরতে পরতে আছে উত্তম গুণের অগণিত ঝলক। তাই আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। ’ (সুরা : কলম, আয়াত : ৪)
জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ও কিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে কাছে থাকবে যে তোমাদের মধ্যে অধিকতর সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। আর আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ও আমার কাছ থেকে সবচেয়ে দূরে থাকবে বাচাল ও অহংকারী। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ২১০৮)
অন্তরের সজীবতা ও তরুমনের সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে মানুষের আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা ও কাজকর্মে। তাই ইসলাম সবার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছে। নিম্নে উত্তম গুণাবলি বর্ণনা করা হলো।
সত্যবাদিতা : সত্য কথা মানুষের জীবনকে সুন্দর করে। তাই সত্যবাদিতা মুমিনের ভূষণ। সফলতার পথে নিয়ে আসে সততা। আর ধ্বংসের পথে পৌঁছে দেয় মিথ্যা ও কপটতা। তাই মহান আল্লাহ সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। তিনি তোমাদের কর্ম ত্রুটিমুক্ত করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে, তারা অবশ্যই সফলকাম হবে। ’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৭০-৭১)
ধৈর্য ধারণ : বিপদাপদের মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কঠিন সময়ে অস্থির না হয়ে আল্লাহর কাছে পুণ্যের প্রত্যাশা করা জরুরি। কারণ ধৈর্যের ফল অনেক সুখকর। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করল এবং ধৈর্য ধারণ করল, আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নিষ্ফল করেন না। ’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৯০)
আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ধৈর্যধারণের চেষ্টা করবে, আল্লাহ তাকে ধৈর্যধারণের সুযোগ দেবেন। আর ধৈর্যের চেয়ে অধিকতর ব্যাপক ও কল্যাণকর কোনো কিছু কাউকে দেওয়া হয়নি। ’ (বুখারি, হাদিস : ১৪৬৯, মুসলিম, হাদিস : ১০৫৩)
সুন্দর কথা : সবার সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বলা সদকার সমতুল্য। সুন্দর কথা মানুষের অন্তরে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সূর্য উদিত হওয়া প্রতিটি দিবসেই মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর সদকা দেওয়া আবশ্যক হয়। দুজনের মধ্যে বিবাদ নিরসন করা সদকার সমতুল্য। কাউকে বাহনে উঠতে কিংবা কোনো সামগ্রী বাহনে তুলে দিতে সাহায্য করা সদকা। সুন্দর কথা বলা সদকা। নামাজে যাওয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ সদকা। পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা সদকা। ’ (মুসলিম, হাদিস : ১০০৯)
অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার : সময়ের মূল্য অপরিসীম। তাই একজন মুসলিমের অনর্থক কাজে লিপ্ত হওয়া অনুচিত। ইসলামের সৌন্দর্য হলো অনর্থক কাজকর্ম পরিহার করা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হলো অনর্থক কাজ পরিহার করা। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩১৮)
অতিথিপরায়ণতা : অতিথির সমাদর ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। সাধ্যানুযায়ী অতিথির আদর-আপ্যায়ন করা একজন মুসলিমের অন্যতম কর্তব্য। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেউ আল্লাহ ও আখিরাতের ওপর ঈমান আনলে সে যেন কল্যাণকর কথা বলে নতুবা চুপ থাকে। কেউ আল্লাহ ও আখিরাতের ওপর ঈমান আনলে সে যেন প্রতিবেশীকে সম্মান করে। কেউ আল্লাহ ও আখিরাতের ওপর ঈমান আনলে সে যেন অতিথির সমাদর করে। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬০১৮)
বিনয় ও কোমলতা : কোমল ব্যবহার দ্বারা ব্যক্তি সবার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। বিনয় ও কোমলতার ছোঁয়ায় সবার মন হয়ে ওঠে আনন্দঘন। তাই রাসুল (সা.) সবার সঙ্গে অত্যন্ত কোমল আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ কোমলতাকে পছন্দ করেন। আল্লাহ কোমলতার বদলায় যা দেন, কঠোরতার কারণে তা দেন না। ’ (বুখারি, হাদিস : ২৫৯৩)
মানুষের জন্য কল্যাণ কামনা : সবার জন্য কল্যাণের প্রত্যাশা করা একজন মুসলিমের অন্যতম গুণ। পরামর্শ, উপদেশ, নির্দেশনাসহ অসংখ্য উপায়ে মানবসমাজের সব সদস্যের কল্যাণ কামনা করা যায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘একজন মুসলিমের ওপর অন্য মুসলিমের ছয়টি অধিকার আছে। ’ তখন বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, তা কী? তিনি বলেছেন, “মুসলিমের সঙ্গে তোমার দেখা হলে সালাম দেবে। তোমাকে ডাকলে সাড়া দেবে। তোমার কাছে পরামর্শ চাইলে উত্তম পরামর্শ দেবে। হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বললে তুমি তার উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলবে। অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাবে। আর মারা গেলে তার জানাজায় অংশগ্রহণ করবে। ” (মুসলিম, হাদিস : ২১৬২)
ক্রোধ সংবরণ : প্রাত্যহিক জীবনে অন্যের ওপর ক্রোধান্বিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে ক্রোধ দমন করা ও প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত থাকা মুসলিমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তা অনেক বড় পুণ্যের কাজ। রাগ দমনকারীর মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক উঁচু। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা রবের ক্ষমার দিকে এবং আসমান ও জমিনের সমান বিস্তৃত জান্নাতের দিকে দৌড়ে যাও, যা খোদাভীরুদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে, ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল, আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৩-১৩)
ঝগড়া-বিবাদ নিরসন : পরস্পরের মধ্যে বিদ্যমান ঝগড়া-বিবাদ নিরসনে মানুষ এগিয়ে এলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা অটুট থাকবে। তাই যে তা নিরসনে এগিয়ে আসবে, সে মহাপুণ্যের অধিকারী হবে। আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের রোজা, নামাজ ও সদকার চেয়ে অধিকতর উত্তম কাজের কথা বলব না?’ সাহাবারা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, অবশ্যই বলবেন। তিনি বললেন, ‘পরস্পরের মধ্যে বিবাদ নিরসন করা। কারণ পরস্পরের মধ্যে থাকা বিবাদই সব কিছু ধ্বংস করে। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৫০৯)
সুধারণা পোষণ : মানুষের প্রতি সুধারণা পোষণ করা সব মুসলিমের কর্তব্য। অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণের কারণে মনোমালিন্য ও হিংসা-বিদ্বেষ তৈরি হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা বেশির ভাগ ধারণাকে পরিহার করো। কেননা অনেক ধারণা পাপের শামিল। ’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১৩)
মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
0 মন্তব্যসমূহ